মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় কি? হাদিসের আলোকে উত্তর

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় কি? হাদিসের আলোকে উত্তর

ভূমিকা-

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় মুখের দুর্গন্ধের কারণে আমরা অনেক সময় মন খুলে কথা বলতে পারি না। এর জন্য আমাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস অন্যের বিরক্তি ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অপরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা ও প্রাণ ভরে হাসার জন্য মুখের দুর্গন্ধ দূর করা একান্ত প্রয়োজন। আমরা একটু চেষ্টা করলে খুব সহজেই প্রাকৃতিক উপায়ে মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে পারি। এজন্য মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় সম্পর্কে ভালভাবে জেনে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় – একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো মিসওয়াক ব্যবহার

মুখের দূর্গন্ধ দূর করতে মুখ সর্বদা পরিস্কার রাখার বিকল্প কিছু নেই। বিভিন্ন উপায়ে মুখ পরিস্কার রাখা যায়। মুখ পরিস্কার বা মুখের দূর্গন্ধ দূর করার সবচেয়ে বড় উপকরণ হলো ’মিসওয়াক’। মিসওয়াক সুন্নাতের একটি অংশ। মিসওয়াকের ব্যবহার সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

মিসওয়াকের ব্যবহার সম্পর্কে হাদিস-

রাসুল (সঃ) বলেন- কখনো এমনটি হয়নি যে, জিবরাইল (আঃ) আমার কাছে এসেছেন, আর মিসওয়াকের নির্দেশ দেননি (মুসনাদে আহমাদ)।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রাসুল (সঃ) বলেন- ‘যদি আমি আমার উম্মতের ওপর কঠিন মনে না করতাম, তাহলে প্রতি নামাজের সময়ই মিসওয়াকের নির্দেশ দিতাম’ (বুখারি)।

হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেন- ‘রাসুল (সঃ) যখন ঘুম থেকে উঠতেন তখন মিসওয়াক করে নিতেন’(বুখারি)।

মিসওয়াক করা আগের নবীদেরও সুন্নত। আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত- রসুল (সঃ) বলেন, ‘চারটি বিষয় নবীদের সুন্নত । যথা-

১. লজ্জা করা

২. সুগন্ধি ব্যবহার করা

৩. মিসওয়াক করা

৪. বিয়ে করা’ (তিরমিজি)।

প্রত্যেক সলাতের জন্য অযুর পূর্বে মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রাসুল (সঃ) বলেছেন- ‘মিসওয়াক করে যে সলাত আদায় করা হয় তা মিসওয়াকবিহীন সলাতের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সওয়াব হয় (বায়হাকি)।

অন্য এক হাদীসে এসেছে-

রাসুল (সঃ) রাতে ঘুম থেকে জেগে মিসওয়াক করতেন। রাতে ঘুমানোর পূর্বে মিসওয়াক করা তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল।

মিসওয়াকের গুরুত্ব সম্পর্কে উপরোক্ত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই বুঝা যায়- ইসলাম মিসওয়াককে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।

রাসুল (সঃ) মিসওয়াক করার যে পদ্ধতি এবং সময় বর্ণনা করেছেন সে সম্পর্কে একটু ভালভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়- তিনি প্রতিদিন অন্তত ৫ ওয়াক্ত সলাতের পূর্বে ৫বার এবং ঘুমানোর পূর্বে ও ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক করতেন। এখন প্রশ্ন হলো- ৫ ওয়াক্ত সলাতের পূর্বে ৫বার এবং ঘুমানোর পূর্বে ও ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক করলে কি মুখে আর জীবানু সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর মুখে যদি জীবানু সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ না থাকে, তবে মুখে দুর্গন্ধ হবে কি করে? কেউ যদি শুধুমাত্র মিসওয়াকের এই সুন্নাতটি আমল করেন তার মুখে কোন প্রকার দুর্গন্ধের সৃষ্টি হবে না। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সুন্নাতের এই আমল ছাড়াও আরও কিছু প্রাকৃতিক পদ্ধতি রয়েছে। যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে খুব সহজেই মুখের দুর্গন্ধ দূর করা যায়। নিম্নে সে সম্পর্কে কিছু পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।

অন্যান্য রোগের কারণে মুখে দুর্গন্ধ-

শরীরের অন্যান্য রোগের কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। যে সকল রোগ থেকে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে তা নিম্নরূপ-

  • টাইপ-১ ডায়াবেটিসের কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। কেননা দেহে ইনসুলিনের অভাব হলে এ সমস্যা দেখা দেয়।
  • মুখের ভেতর স্যালিভা শুকিয়ে গিয়ে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেওয়ার কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
  • সাইনাসের সমস্যার কারণে গলা ও নাকে মিউকাস জমে থাকায় মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
  • খাবারে প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে মুখে টক টক গন্ধ হতে পারে।
  • কিডনী সমস্যার কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
  • টনসিলের সমস্যা থেকে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। যার ফলে মুখে দুর্গন্ধ তৈরি হয়।
  • ফুসফুসের ক্যান্সার থেকেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
  • লিভারে সমস্যা থাকলেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেও এ সমস্যা হতে পারে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়

খাবারের পর মুখের ভিতরের অংশ পরিস্কার করা-

খাবার গ্রহণের পর ছোট ছোট খাদ্য কণা আমাদের মুখের বিভিন্ন স্থানে ও দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে আটকে থাকে। আটকে থাকা এ খাদ্য কণাগুলো ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয়। মুখের বিভিন্ন অংশে আটকে থাকা খাদ্য কণা হতে জন্ম নেওয়া এই ব্যাকটিরিয়াগুলো মুখে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। তাই খাবার খাওয়ার পর ভালভাবে মুখের ভিতরের অংশ পরিস্কার করুন অথবা ব্রাশ করুন। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর পূর্বে দাঁত ব্রাশ করুন। এতে করে মুখের ভিতরে আটকে থাকা খাদ্য কণাগুলো চলে যাবে এবং মুখের দুর্গন্ধ অনেকাংশে কমে যাবে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়সঠিক নিয়মে ব্রাশ করা

খাবার খাওয়ার পর ব্রাশ করলেও অনেকের মুখে দুর্গন্ধ থেকেই যায়। ইহার কারণ সঠিক নিয়মে ব্রাশ না করা। তাই ব্রাশ করার সময় খেয়াল করে দাঁতের ভিতর বাহির উভয়দিকে এবং দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে ভালভাবে ব্রাশ করতে হবে। এছাড়াও জিহ্বা ও উপরের তালুতেও হালকা ভাবে ব্রাশ করতে হবে। এতে মুখের দুর্গন্ধ কমে যাবে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়মাউথ ওয়াশ ব্যবহার

মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ভালো কোন ব্র্যান্ডিং কোম্পানীর মাউথ ওয়াশ নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন। আশা করি অনেক উপকার পাবেন।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়দারুচিনির ব্যবহার

দারুচিনি মুখে উৎপাদিত ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে এবং দারুচিনির সুগন্ধ মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। এজন্য দারুচিনির ছোট্ট একটি টুকরা মুখে নিয়ে মাঝে মাঝে চিবাতে হবে। তবে এটা সম্ভব না হলে দাঁত ব্রাশ করার সময় টুথপেস্টের সাথে দারুচিনির তেল ব্যবহার করুন। এতে মুখের দুর্গন্ধ আস্তে আস্তে কমে যাবে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়লবঙ্গের ব্যবহার

দারুচিনির মত লবঙ্গও মুখে উৎপাদিত ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে। তাই আপনার পেস্টের সাথে লবঙ্গের ব্যবহার করুন। লবঙ্গের পেষ্ট মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়- গরম পানি পান করা

গরম পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। গরম পানি মুখের ভিতরে থাকা জীবানু ধ্বংস করে। যার ফলে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় না। তবে খেয়াল রাখতে হবে পানি যেন বেশী গরম না হয়। পানি বেশী গরম হলে অসাবধানতা বশতঃ মুখ, জিহ্বা ও কন্ঠনালী পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য কুসুম কুসুম গরম পানি অথবা মুখে সহ্য হয় এমন তাপমাত্রার পানি পান করা উচিত।

আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ-

আঁশযুক্ত খাবার যেমন- পেয়ারা, আপেল, আঁখ, গাজর ও আনারস খেতে পারেন। এই খাবারগুলো মুখে আটকে থাকা খাদ্য কণা দূর করে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়কাঁচা পেঁয়াজ ও রসুন খাওয়া বন্ধ করা

কাঁচা পেঁয়াজ ও রসুন খাওয়া বন্ধ করতে হবে। কাঁচা পেয়াজ ও রসুন মুখে অনেক বেশি দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। এজন্য কাঁচা পেঁয়াজ বা রসুন না খাওয়াই ভাল। তবে যদি খেতেই হয়, খাওয়ার পর অবশ্যই ভালোভাবে মুখ পরিষ্কার করুন।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়লবণযুক্ত গরম পানি

সবার ঘরে কমবেশি লবণ থাকে। তাই আমরা সহজেই এটার ব্যবহার করতে পারি। হালকা কুসুম গরম পানিতে এক চা চামচ লবণ মিশিয়ে এটা দিয়ে কুলি করতে পারেন। এতে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়নিমের মাজন ব্যবহার

  • নিম মুখের ভিতরে উৎপাদিত ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
  • নিমের মাজন দাঁতের গোড়া শক্ত ও মজবুত করে।
  • নিম গাছ থেকে প্রস্তুতকৃত নিমের মাজন দাঁত ঝকঝকে ও পরিস্কার রাখতে সাহায্য করে।
  • নিমের মাজন মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
  • তাই যুগ যুগ ধরে মানুষ প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসাবে নিম এর ব্যবহার করছে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়লেবুর রস খাওয়া

লেবুর রস মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে। লেবুর রসে থাকা এসিড মুখগহ্বরের জীবানু ধ্বংস করে। এছাড়া লেবুতে থাকা ভিটামিন দাঁতের মাড়ি ও গোড়াকে শক্ত এবং মজবুত করে।

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়বেকিং সোডা ব্যবহার

শরিরের এসিড লেভের এর তারতম্যের জন্য মুখে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। বেকিং সোডা এসিড লেভেল ঠিক রাখতে সাহায্য করে। তাই আধা চামচ বেকিং সোডা পরিমান মত পানিতে মিশিয়ে কুলি করুন। অথবা পেস্টের সাথে মিশিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন।

ডায়াবেটিস কেন হয় এবং ডায়াবেটিস কমানোর উপায় কি?

চুল পড়ার কারণ ও প্রতিকার

দাঁতের যত্ন নিন সুস্থ্য থাকুন

শীতে ত্বকের যত্ন ও পরিচর্যা

কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়ধুমপান বর্জন করা-

সকল নেশা জাতীয় দ্রব্য সম্পূর্ণভাবে বর্জন করুন। ধুমপান করলে মুখে দূর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। এগুলো শুধুমাত্র মুখে দুর্গন্ধই সৃষ্টি করে না বরং শারীরিকভাবে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। যেমন- বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার, স্ট্রোক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, হাড় ক্ষয়, শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা, যক্ষ্মা, ফুসফুসের ইনফেকশন, শারিরীক সক্ষমতা কমে যাওয়া, শরীরে বিভিন্ন স্থানে রক্ত চলাচল অস্বাভাবিক করে ইত্যাদি। এছাড়া ধুমপান পরিবেশের ভারসাম্যতা নষ্ট করে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা আসলেই অনেক বোকা। ধুমপানের এতো ক্ষতিকারক দিক জেনেও আমরা অনেকেই ধুমপান করি। সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো- সিগারেট কোম্পানীগুলো সিগারেটের প্যাকেটে লিখে দেয়-

“ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” বা “ধুমপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়” এ সকল সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেখেও আমরা বোকার মতো ধুমপান করেই চলেছি।

গ্রিণ টি-

মুখে জমে থাকা খাবার হতে ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। গ্রিণ-টি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। তাই খাবার খাওয়ার পর গ্রিণ-টি পান করুন।

ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়া-

মুখের ক্ষত বা ঘাঁ হতে মুখে দুর্গন্ধ তৈরী হয়। এজন্য বেশি পরিমানে ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার গ্রহন করতে হবে।

উপসংহার-

মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয়- মুখের দুর্গন্ধ অনেক সময় লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অধিক পরিমানে সম্মানহানী করে। কারো সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায় না। কথা বলতে ভয় লাগে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রিয়জনও ঘৃণা করে। ছোট হতে হয় অনেকের নিকট। মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় সম্পর্কে ইসলাম যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে বলেছে অর্থাৎ মিসওয়াকের সঠিক ব্যবহার করার পাশাপাশি উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করুন। আশা করা যায় এ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের ফলে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যাবে।

দাঁতের যত্ন নিতে বিস্তারিত জানুন

6 thoughts on “মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় কি? হাদিসের আলোকে উত্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *