ভূমিকা-
শীতে ত্বকের যত্ন- ত্বক আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্নভাবে ত্বকের যত্ন নিতে হয়। মানুষের ত্বকে সিবেসিয়াস গ্রন্থি নামে এক ধরনের অতি ছোট এক্সক্রনিক গ্রন্থি রয়েছে। এই গ্রন্থি থেকে সিবাম নামের এক ধরনের তৈলাক্ত মোমের মত রস বের হয়, যা ঘামের সাথে শরীরের সমস্ত চামরায় ছড়িয়ে পড়ে। সিবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত এই সিবাম ঘামের সাথে মিশে চামড়াকে মসৃণ ও জলরোধী করে। যার ফলে চামড়া ফাটে না। কিন্তু শীতকালে মানুষের শরীর ঘামে না বিধায় সিবাম চামড়ায় ছড়াতে পারে না এবং শীতে বাতাসে জ্বলীয় বাষ্পের পরিমান কমে যাওয়ায় ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়। এজন্য শীতে ত্বকের যত্ন ও সঠিকভাবে পরিচর্যা করা একান্ত প্রয়োজন।
শীতকালে শুষ্কতার প্রভাবটা মানুষের শরীরের ত্বকের তুলনায় ঠোঁট এর উপর বেশি পড়ে। ঠোঁটের উপর বেশি পড়ার কারণ ঠোঁট নাকের কাছে হওয়ায় নিশ্বাস ত্যাগ করার সময় যে গরম বাতাস বের হয় তা ঠোঁটকে আরও শুষ্ক করে তুলে। তাই শীতকালে মানুষের ঠোঁট ফেটে যায়। ঠোঁটের পাশাপাশি মানুষের ত্বকের অন্যান্য অংশ যেমন হাত-পায়ের ত্বকেও শীতকালে শুষ্ক ও রুক্ষ ভাবটা দেখা যায়। শীতে অনেকের পায়ের গোড়ালিও ফেটে যায়। এছাড়াও শীতে মানুষের বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দেয়। তাই শীত আসার আগেই ত্বকের নানা সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ত্বকের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। শীতে ত্বকের যত্ন সঠিকভাবে নিলে ত্বক থাকবে সুন্দর ও মসৃণ।
শীতে ত্বকের যত্ন সঠিকভাবে না করলে কি কি সমস্যা হতে পারে-
- ঠোঁট ফেটে যায়
- পায়ের গোড়ালী ফেটে যায়
- ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়
- মাথায় খুশকি হয়
- ত্বক ফেটে যায়
- খোস পাঁচড়া বা চুলকানি হয়
- বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ হয়
- সোরিয়াসিস নামক ক্রনিক চর্মরোগ ত্বক শুষ্কতার ফলে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে
- চেহারা বা ত্বকের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়
- এলার্জি জনিত রোগ বৃদ্ধি পায়
- শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চাক চাক লালচে রং হয়ে যায়
শীতে ত্বকের যত্ন নিতে শরীরের কোন কোন অংশ বেশি পরিচর্যা করতে হবে-
- ঠোঁটের যত্ন
- মুখের যত্ন
- হাতের যত্ন
- পায়ের গোড়ালির যত্ন
- মাথার ত্বকের যত্ন। মাথায় ত্বকের যত্ন সঠিকভাবে না করলে খুশকি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শীতে ত্বকের যত্ন নিতে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন-
শীতকালে আবহাওয়ার শুষ্কতার সাথে সাথে ত্বকও শুষ্ক হতে শুরু করে। তাই ত্বকের শুষ্কতা দূর করতে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা দরকার। ময়েশ্চারাইজার এর কাজ হলো শুষ্ক ত্বকের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রন করা। ময়েশ্চারাইজার ত্বকের উপরে এক ধরনের প্রটেক্টিভ লেয়ার তৈরী যা পরিবেশের ক্ষতিকর জীবাণু এবং ধুলাবালি হতে ত্বককে প্রটেক্ট করে। শীতকালে ওয়েলি প্রকৃতির ময়েশ্চারাইজার বেশি কার্যকারী।
শীতে ত্বকের যত্ন নিতে সানস্ক্রিন এর ব্যবহার-
শীতকালে রোদের প্রভাব কম থাকায় অনেকেই সানস্ক্রিন ব্যবহার করে না বা প্রয়োজন মনে করেনা। সূর্য হতে নির্শিত অতিবেগুনী রশ্নি ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। গ্রীষ্মকাল কিংবা শীতকাল সব সময় সূর্য হতে অতিবেগুনী রশ্নি নির্শিত হয়। তাই শীতেও বাহিরে বের হওয়ার জন্য হাত, পা ও মুখে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এছাড়াও সূর্য হতে ইউভি রশ্নি নির্শিত হয়, যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। ইউভি রশ্নি মেঘ ও গ্লাস ভেদ করে চলে আসে। ইউভি রশ্নি ত্বকের ভিতরের স্তরকে নষ্ট করে যার ফলে ত্বকে অকালে বয়স্কতার চাপ পরে এবং স্কিন ক্যানসার এর আসঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এই জন্য শীতকালেও ত্বকের সুরক্ষার জন্য সানস্ক্রিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এছাড়াও সানস্ক্রিন ত্বকে বয়সের ছাপ কমিয়ে দেয়। শীতের শুষ্ক আবহাওয়া ত্বকে শুষ্কতার হার বাড়িয়ে মসৃণতার পরিমান কমিয়ে দেয় যার ফলে সৌন্দর্যহানি হয়। সানস্ক্রিন ব্যবহারের ফলে ত্বকের উপরে একটি প্রটেক্টিভ লেয়ার তৈরী হয় যা শীতের শুষ্ক আবহাওয়া হতে ত্বককে রক্ষা করে।
শীতে ত্বকের যত্ন নিতে প্রয়োজনীয় পানি পান করুন-
শীতের মৌসুমে শরীর ঘামে খুবই কম। যে কারণে পানি পিপাসা লাগে না। গীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে পানি খুবই কম পান করা হয়। পানি পান করার পরিমান কমে যাওয়ায় ত্বকের লাবণ্যতা কমে যায়। পানি পান কম করলে পানি শূন্যতা দেখা দেয় এবং তা ত্বককে খসখসে ও রুক্ষ করে তোলে। তবে ঠান্ডা পানির তুলনায় গরম পানি পান করলে বেশি উপকৃত হওয়া যায়। গরম পানি পান করলে শরিরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে শরীর ঘামতে সাহায্য করে। যার ফলে ত্বকের শুষ্ক প্রভাব কমে যায়। এছাড়া গরম পানি পান করলে মাথার খুশকির পরিমান কমে যায় এবং চুলের সেলের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে চুল মোটা ও শক্ত হয় এবং চুল পড়া কমে যায়।
গরম পানি পান করলে কাশি, গাঁটের ব্যথা, হাঁপানি রোগ, জরায়ু ও মুত্র সম্পকৃত রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন, জয়েন্টের ব্যথা, কোলেস্টেরলের মাত্রা, মৃগী রোগ, হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি বা হ্রাস, মাথা ব্যথা, ক্ষুধার সমস্যা এবং পেটের সমস্যায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এজন্য শুধু ত্বককে রক্ষা করতে পানি পান নয় বরং সুস্বাস্থ্যের জন্যও বেশি বেশি পানি পান করা উচিত।
শীতে ত্বকের যত্ন নিতে নিয়মিত গোসল করুন-
নিয়মিত গোসল করলে ত্বকের শুষ্কতার ভাব কমে। শীতকালে অনেকেই গরম পানি দেয়ে গোসল করে। গরম পানি দিয়ে গোসল করলে তাৎক্ষনিক আরাম উপভোগ করলেও পরে তা ত্বককে শুষ্ক ও রুক্ষ করে তুলে। এছাড়া মাথায় গরম পানি ব্যবহার করলে মাথা ত্বক শুষ্ক হয়ে চুল পড়া বৃদ্ধি পায়। শীতকালে হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন। তবে মাথায় গরম পানি ব্যবহার করা যাবে না। গোসলে পর ভিজা চুল নিয়ে বাহিরে বের হবেন না এতে চুল ফেটে যাওয়ার পরিমান বেড়ে যাবে। গোসলের পর ভেজা অবস্থায় ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহার করলে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকবে।
মুখের যত্ন নিন-
শীতকালে বাতাস শুষ্ক থাকায় মূখের আদ্রতা কমে যায় তাই আদ্রতা বজায় রাখতে কিছুক্ষণ পর পর মুখে পরিস্কার পানির যাপটা দেওয়া দরকার। এতে মুখের ত্বকে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার হবে। অনেকেই সকালে মেকাআপ নিয়ে বাহিরে বের হয় তাদের ক্ষেত্রে রাতে বাসায় ফিরে মুখ ভালভাবে ধুয়ে তারপর ময়েশ্চারাইজার যুক্ত ক্রিম ব্যবহার করা উচিত। এতে ত্বকে আটকে যাওয়া ধুলাবালি ও কলখানার, গাড়ির ক্ষতিকারক ধোঁয়া জমে ত্বকের বন্ধ হওয়া ছিদ্রগুলো খোলে যাবে যার ফলে ব্রণ ও কালো দাগ হওয়া থেকে ত্বক রক্ষা পাবে। শীতে আরামের জন্য মূখে গরম পানি ব্যবহার করবেন না এতে ত্বকের আদ্রতা কমে যায়। রাতে ঘুমানোর আগে মূখের ত্বক ভালভাবে পরিষ্কার করে ময়েশ্চারাইজার যুক্ত ক্রিম ব্যবহার করুন। একটানা অনেক সময় ঘুমানোর জন্য রাতে ব্যবহৃত ক্রিম ভাল কার্যকর হয়।
ঠোঁটের যত্ন নিন-
ঠান্ডা বাতাসে ঠোঁটের ত্বক রুক্ষ হয়ে ফেটে যায়। এছাড়া ঠোঁট নাকের কাছাকাছি হওয়ার নিশ্বাসে গরম বাতাস বের হয়ে ঠোঁটের আদ্রতা কমে গিয়ে ঠোঁট ফেটে যায়। অনেকে ঠোঁটের আদ্রতা বাজার রাখার জন্য জিভ দিয়ে ঠোঁট বিজিয়ে রাখার চেষ্টা করে এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। তাই ঠোঁটের ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখতে গ্লিসারিন বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করুন।
হাতের যত্ন নিন-
মানুষ মুখের ত্বকের যে পরিমান যত্ন নেয়, হাত বা শরিরের অন্যান্য ত্বকের প্রতি সে পরিমান যত্ন নেয় না। শীতকালে মুখের ত্বকের নেয় হাতের শুষ্কতা ও রুক্ষতার পরিমান বেড়ে যায়। অনেকেই বারবার হাত ধুতে হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা বেশী হয়। তাই হাতের শুষ্কতা ও রুক্ষতার পরিমান কমাতে এবং আদ্রতা ও মসৃণতার পরিমান বাড়াতে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। বিশেষ করে যাঁদের বেশি বেশি হাত ধুতে হয় বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হয় তারা হাত ধুয়া ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের পর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
পায়ের যত্ন নিন-
শীতকালে অনেকের পা গুড়ালি ফাটতে দেখা যায়। শীতের শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। পায়ের ত্বকের শুষ্কতার পরিমান কমাতে পায়ে পেট্রোলিয়াম জেলি অথবা গ্লিসারিন ব্যবহার করুন। এতে পায়ের ত্বক নরম ও মসৃণ থাকবে। এছাড়া পা ভাল করে পরিষ্কার করুন। পায়ে মোজা ব্যবহার করুন। ৬-৭ দিন পর পর এক্সিফোলিয়েট করে পায়ের ত্বকের মৃত কোষগুলো সরিয়ে নিন। মৃত কোষগুলোতে রক্ত সঞ্চলন না হওয়ায় রুক্ষ হয়ে পা পাঠতে শুরু করে। তাই নিয়ম করে পায়ের যত্ন নিন আর নিয়ম অনুযায়ী পায়ের যত্ন নিলে পায়ের ত্বক সুন্দর ও মসৃন থাকবে।
শীতে ত্বকের যত্ন নিতে চর্ম বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন-
শীতে অনেকের ত্বক রুক্ষতার কারণে ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়। এছাড়াও অনেকের শীতকালে খোসপাঁচড়া ও খাজলি সহ নানা ধরনের চর্মরোগ হতে দেখা যায়। তাদের উচিত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া। শীতে ত্বকের যত্ন নিতে অবহেলা করা উচিত নয়। অবহেলা করলে ত্বকের মসৃণতা কমে ত্বক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও ত্বকে নানা প্রকার চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
সৌন্দর্য্য ও ফিটনেস সম্পর্কে জানতে আরও পড়ুন
মাথায় খুশকি হওয়ার কারণ ও খুশকি দূর করার উপায়
দাঁত সুস্থ্য রাখতে দাঁতের যত্ন
ডায়াবেটিস কেন হয় এবং ডায়াবেটিস কমানোর উপায় কি?
কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা
খুশকি সম্পর্কে আরও পড়ুন
2 thoughts on “শীতে ত্বকের যত্ন ও পরিচর্যা”